Mycorrhiza in Environmental Protection—A modern Biofertilizer
পরিবেশ রক্ষায় মাইকোরাইজা—একটি আধুনিক বায়োফর্টিলাইজার
মাইকোরাইজা কি আলোচনা শুরুর আগে একটু ভুমিকা প্রয়োজন। জীব জগতের প্রত্যেকটি সদস্য পারস্পরিকভাবে সম্পর্কযুক্ত। জীবনধারনের প্রয়োজনীয় শক্তির জন্য প্রানীসমূহ উদ্ভিদের উপর, মাংসাশী প্রানী সমূহ তৃনভোজী প্রানীদের উপর, অনুজীব সমূহ অন্য প্রানীদের উপর অথবা অন্য অনুজীবের উপর প্রত্যক্ষ বা প্ররোক্ষভাবে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা কখনো একমুখী হয়; আবার কখনো উভয়মুখী হয়। কখনো ক্ষতিকারক আবার কখনো উভয়ের জন্য উপকারক হয়। উপকারী সহজীবিতার ক্ষেত্রে দুইটি সদস্য একত্রে বসবাস করে এবং একে অপরের উপকার করে। জীবজগতে এ রকম উপকারী সহজীবিতার অনেক উদাহরন আছে। যেমন: লাইকেন ( ছত্রাক ও শৈবালের মধ্যে সহজীবিতা), নড্যুল ব্যাকটেরিয়া( ব্যাকটেরিয়া ও উদ্ভিদের মূলের মধ্যে সহ জীবিতা) ইত্যাদি।
মাইকোরাইজা কি?
মাইকোরাইজা হলো মাটিস্থ ছত্রাক ও সবুজ উদ্ভিদের মূলের মধ্যে সহাবস্থান। মাটিস্থ ছত্রাক সমূহ উচ্চতর সবুজ উদ্ভিদের মূলের মধ্যে আশ্রয় গ্রহন করে এবং মূল থেকে কার্বোহাইড্রেট গ্রহন করে। পক্ষান্তরে মূল মাটি থেকে ফসফরাস সংগ্রহের জন্য ছত্রাকের সহায়তা গ্রহন করে। ফসফরাস ছাড়াও মাটি থেকে বিভিন্ন পুষ্টি সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে উদ্ভিদকে সহায়তা করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাইকোরাইজা শব্দটি নতুনই বলা চলে। মাইকোরাইজা এখনও আমাদের দেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেনি। বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে, বনজ চারা উৎপাদনকারী নার্সারী ইত্যাদি ক্ষেত্রে মাইকোরাইজা বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়।
১৮৮৫ সালে জার্মান উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর্ A.B. Frank সর্বপ্রথম মাইকোরাইজা আবিস্কার করেন। তিনি জার্মান সরকারের প্রকল্পাধীন ট্রাফল (Truffle) নামক এক প্রকার খাদ্যোপযোগী মাশরুমের গবেষনার সময় মাইকোরাইজা আবিস্কার করেন।
মাইকোরাইজা প্রধানত: দুই প্রকার:-
A. Ectomycorrhiza
B. Endomycorrhiza
এই গ্রুপে আরও ছয় প্রকার মাইকোরাইজা আছে;
- Ectendomycorrhiza
- Arbutoid mycorrhiza
- Monotropoid mycorrhiza
- Ericoid mycorrhiza
- Orchid mycorrhiza
- Vesicular arbuscular mycorrhiza
এদের মধ্যে এক্টোমাইকোরাইজা এবং ভেসিকুলার আর্বাস্কুলার মাইকোরাইজা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ন। এক্টোমাইকোরাইজার ক্ষেত্রে ছত্রাক সমূহ উন্নত প্রকৃতির এবং Basidiomycetes শ্রেনীভুক্ত। এরা বর্ন্ধনশীল মূলের অগ্রভাগে দৈহিক সূত্রের একটি বহিস্থ আবরন গঠন করে এবং দৈহিক অনুসূত্র আন্তকোষীয় ফাকে ফাকে প্রবেশ করে। কিন্তু মূলের কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে না।ভেসিকুলার আর্বাস্কুলার মাইকোরাইজা ক্ষেত্রে ছত্রাকের দেহসূত্রগুলি আন্তকোষীয় পাকে পাকে এবং কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এরা Zygomycetes শ্রেনীর অর্ন্তভুক্ত। বর্তমানে এদেরকে আর্বাস্কুলার মাইকোরাইজা হিসাবে নামকরন করা হয়। উভয় প্রকার মাইকোরাইজার ক্ষেত্রে ছত্রাক দেহসূত্র মূলের বাইরে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে।
মাইকোরাইজা পোষক উদ্ভিদের অনেক উপকার করে থাকে। আগেই বলা হয়েছে, মাইকোরাইজা ছত্রাক উদ্বিদের মূল থেকে কার্বোহাইড্রেট গ্রহন করে। মাইকোরাইজা ছত্রাকসমূহ এর পরিবর্তে বিভিন্ন খনিজ পুষ্টি সংগ্রহে উদ্ভিদকে সহায়তা করে। সাধারনত: গ্রীস্ম মন্ডলীয় মাটিতে ফসফরাসের ঘাটতি কম থাকে। মাটিস্থ ফসফরাস সহজে দ্রবীভুত হয় না।তদুপরি মূলরোমের চারদিকে ফসফরাসের ঘাটতি অঞ্চল সৃষ্টি হয়। মাইকোরাইজা ছত্রাকের দেহসূত্রগুলি মূল থেকে অনেকদুর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়; ফলে ঘাটতি অঞ্চলের দুরবর্তী অঞ্চল তেকে ফসফরাস, নাইট্রোজেন,পটাশিয়াম,ম্যাগনেশিয়াম, জিন্ক,কপার,সালফার,বোরন,মলিবডেনাম ইত্যাদি আহরন করে। তাছাড়া মৃত্তিকা উন্নয়ন ও মৃত্তিকার ক্ষয়রোধ কর।খরা অবস্থায় উদ্ভিদের পানি সংকটে মাইকোরাইজা বিশেষ সহায়তা করে। পরোক্ষ উপকারের ক্ষেত্রেও মাইকোরাইজা ছত্রাক গুরুত্বর্পর্ন। লেগুমিনাস উদ্ভিদের মূরে নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী ব্যাকটেরিয়া এবং এ্যাকটিনোমাইসিটিস জাতীয় অনুজীব সমূহের বৃদ্বি এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে মাইকোরাইজা ছত্রাক বিশেষ ভুমিকা পালন করে থাকে।উদ্ভিদ সমূহের জন্য মৃত্তিকাস্থ রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাক বা অন্যান্য জীবানু বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে। যেমন: টমেটোর গোড়া পচা রোগ, মরিচের চারার গোড়াপচা রোগ ইত্যাদি।এছাড়া বিভিন্ন নার্সারীতে বনজ, ফলজ বা পুস্প উৎপাদনকারী চারার ক্ষেত্রে এই জাতীয় মৃত্তিকাবাহী রোগ-জীবানু দমনে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে।
বর্তমান সময়ে পরিবেশ রক্ষা একটি সামাজিক আন্দোলনে হিসেবে চিন্হিত। কৃষিক্ষেত্রে, নার্সারীতে, বনজ ও ফলজ উদ্ভিদ চাষে আমাদের কৃষকরা বিভিন্ন রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আগাছানাশক ব্যবহার করে থাকে। এই সব রাসায়নিক পদার্থ প্রকৃতিকে দুষিত করে তোলে এবং বিভিন্ন উপকারী প্রানী ও অনুজীবের ক্ষতি করে। পরিবেশকে দুষনের হাত থেকে রক্ষার জন্য তাই বর্তমান বিজ্ঞানীগন বায়োটেকনোলজীর দিকে বেশী জোর দিয়ে চলেছেন এবং মাইকোরাইজা ছত্রাকের উপকারিতার কথা বিবেচনা করে একে বায়োফার্টিলাইজার হিসাবে চিন্হিত করেন। বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে যে সব শস্য, সব্জি চাষ হয় তার অধিকাংশই মাইকোরাইজা নির্ভর উদ্ভিদ। যেমন: ধান, গম, মশুর, পিয়াজ, চীনা বাদাম, মিষ্টি আলু,রববটি,সীম,তিল,তিসি ইত্যাদি।বনজ, ফলজ বা পুস্প উৎপাদনকারী উদ্ভিদ গুলিও মাইকোরাইজা নির্ভর। মাইকোরাইজা ছত্রাক কৃষিজ,বনজ,ফলজ বা পুষ্প উৎপাদনকারী উদ্ভিদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই সব উদ্ভিদের চারাকে মাইকোরাইজা সহকারে জন্মানো হলে উদ্ভিদের একদিকে যেমন বৃদ্ধি তরান্বিত হবে অন্যদিকে পরিবেশকে দুষনের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।চারার মৃত্যু হারও অনেক কমে আসবে।উদ্ভিদের চারার স্বাস্থ্যও অনেক সুগঠিত হবে। বাংলাদেশে মাইকোরাইজার ব্যবহার ও গবেষনা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। অথচ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া,থাইল্যান্ড, জাপান, চীন, তাইওয়ান, মালেশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশে মাইকোরাইজা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। অষ্ট্রেলিয়াতে বনায়নের ক্ষেত্রে মাইকোরাইজাকে সরকারীভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে মাইকোরাইজা এর ব্যবহার ও গবেষনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এবং যুগোপযোগীও বটে। এর ফলে একদিকে ব্যয়বহুল রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার ও এর উপর নির্ভরশীলতা কমে আসবে। অন্যদিকে পরিবেশও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে না পারেলে আমাদেরকে আরও পিছিয়ে পড়তে হবে।পরিবেশ সংরক্ষন, উৎপাদন বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ অর্থনৈতিক উন্নতির প্রয়োজনীয় শর্ত। অর্থনৈতিভাবে রাভবান উদ্ভিদের চাষাবাদের ক্ষেত্রে চারা গাছের প্রতিষ্ঠা, রোগ নিয়ন্ত্রন, কৃষিজমির ভুমি ক্ষয় রোধ, মাটির পুষ্টি সংরক্ষন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ন বিষয়াবলীর উপর মাইকোরাইজার প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে উন্নতি লাভ সম্ভব। তাই মাইকোরাইজাকে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন কর্মসুচীতে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
লেখক: পার্থপ্রতিমধর
তথ্যসূত্র: