এটি লণ্ডনে আমাদের শহীদ মিনার। ইস্ট লণ্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল ও অল্ডগেইটের মাঝামাঝি একটি পার্কে অবস্থিত। পার্কটির নাম আলতাব আলি পার্ক। ইস্ট লণ্ডনকে যদি বলি ইউরোপে বাংলাদেশের রাজধানী, তাহলে এই শহীদ মিনারটি হল সেই রাজধানীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বাঙালির গৌরব ও গর্বের নাম। বিলেতে আমাদের আত্মপরিচয়ের নাম। আমাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের স্মারক। লড়াকু বাঙালির সংগ্রাম, ত্যাগ ও অর্জনের এক নান্দনিক স্তম্ভ।
গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি প্রভাত ফেরিতে অংশ নিতে গিয়েছিলাম এই শহীদ মিনারে। গিয়ে দেখি ২১শে ফেব্রুয়ারি রাতে অর্পিত শ্রদ্ধার্ঘগুলো কেমন মায়া ছড়িয়ে রেখেছে শহীদ মিনারের পাদদেশ জুড়ে। লাল, সাদা, বেগুনী ও গোলাপী ফুলগুলো জানান দিচ্ছে শহীদদের প্রতি আমাদের অকৃত্রিম ভালবাসা।
আমি কিছুটা সময় গভীর মনযোগ দিয়ে পুষ্পশোভিত শহীদ মিনারটির দিকে তাকিয়ে থাকি। মনের আয়নায় ভেসে ওঠে ইতিহাসের অধ্যায় থেকে জানা ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস; যে ইতিহাস স্বদেশের জন্য জীবন উৎসর্গের। যে ইতিহাস রক্তে রঞ্জিত। নিজের অজান্তেই আমার চোখ ভিজে যায়। চোখ ভিজে যায় ভাষা শহীদদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় যাঁদের জীবনের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার অধিকার। যাঁদের আত্মত্যাগের কারণে একুশ আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় স্বীকৃত।
আমি পার্কটির চারপাশ তাকিয়ে দেখি। এক অনির্বচনীয় মুগ্ধতায় আমার মন ভরে যায়। এই মুগ্ধতা যতটা না নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে, তারচেয়ে অনেক বেশী ইংরেজদের এই শহরে ব্রিটিশ-বাঙালির শত বছরের অর্জন দেখে। যারা আমাদেরকে প্রায় দু’শ বছর শাসন করেছে তাদের শহর এতো প্রশস্ত জায়গা জুড়ে এরকম একটি শহীদ মিনার মোটেই সাধারণ কোনো কথা নয়। নি:সন্দেহে এ এক বিরাট অর্জন, যে অর্জনে আমার কোনো ভূমিকা নেই কিন্তু আমি এবং আমার প্রজন্মের অনেকেই আজ উপভোগ করছি সেই অর্জনের আনন্দ।
আমি গভীর শ্রদ্ধায় নমিত হই কমিউনিটির সেই সব দেশপ্রেমিক মানুষের প্রতি যাঁদের ঐকান্তিক চেষ্টায়, যাঁদের শ্রমে ও ঘামে, যাঁদের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই শহীদ মিনারটি।
আমি গভীর শ্রদ্ধায় নমিত হই সেই সব মহান মানুষের প্রতি যাঁরা আমাদেরকে দিয়েছেন বিলেতের বুকে বাঙালির আত্মপরিচয়ের এই সুরম্য স্মারক—গৌরব ও গর্বের এই নান্দনিক স্তম্ভ— আমাদের শহীদ মিনার।
ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের অভিবাসনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস যেদিন লেখা হবে, সে ইতিহাসে নি:সন্দেহে তাঁদের নাম লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের স্মরণ করবে গভীর শ্রদ্ধায় ও ভালবাসায়। একুশের দিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি হাতে প্রভাত ফেরিতে আসা প্রজন্মের মনে গভীর ভালবাসায় অনুরণিত হবে একটি গান—
“তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না,
না না না শোধ হবে না।”
সারওয়ার-ই-আলম, ইলফোর্ড, লণ্ডন