জনদুর্ভোগজনস্বার্থনির্বাচিত কলামপরিসেবা

The Solution for Rickshaws and Autorickshaws Should Be Bangladeshi Model

রিকশা ও অটোরিকশার সমাধান হতে হবে বাংলাদেশি মডেলেই : আমীন আল রশীদ, সাংবাদিক

ব্যাটারিচালিত রিকশা বা অটোরিকশা চলতে না দেওয়ার সরকারি নির্দেশনার প্রতিবাদে রবিবার রাজধানীর কালশি এলাকায় বিক্ষোভের সময় একজন পথচারী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। গণমাধ্যমে খবর বলছে, অটোরিকশা চালকদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে সাগর মিয়া (২২) নামে ওই তরুণ আহত হন। এ সময় বিক্ষোভকারীর পুলিশ বক্সে আগুন দেয়। এর আগে তারা ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর অনুমতি চেয়ে মিরপুর-১ ও ১০ নম্বর এবং আগারগাঁও এলাকায় সড়ক অবরোধ করে রাখে। এতে মিরপুরজুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ সময় অবরোধের পর বেলা আড়াইটার দিকে পুলিশ একপাশ দিয়ে বাস ছেড়ে দিলে উত্তেজিত অটোরিকশাচালকরা লাঠি ও ইট দিয়ে বেশ কয়েকটি বাসও ভাঙচুর করে। তবে স্বস্তির খবর হলো, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আজ (২০ মে) জানিয়েছেন যে নিম্ন আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে ঢাকা সিটিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে দেশের ২২টি মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ থাকার কথাও তিনি জানান।

তারপরও এই ঘটনায় কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসছে।

  • ১. সরকার কেন রাজধানীতে হঠাৎ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?
  • ২. যেসব পায়ে চালিত রিকশার রূপান্তর ঘটিয়ে এরইমধ্যে অটোরিকশা বানানো হয়েছে, সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী?
  • ৩. যদি অটোরিকশাকে এখন অবৈধ বলে এগুলো নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে হাজার হাজার রিকশা প্রশাসনের চোখের সামনে কী করে অটোরিকশায় পরিণত হলো এবং এতদিন এগুলো কেন রাস্তায় চললো?
  • ৪. অটোরিকশার কারণে এখন পায়েচালিত রিকশার সংখ্যা রাজধানী তো বটেই, সারা দেশেই কমে গেছে। সুতরাং হঠাৎ করে অটোরিকশা বন্ধ করে দিলে রাস্তায় যে যানবাহনের তীব্র সংকট হবে এবং তার ফলে যে জনভোগান্তি হবে, সেটির প্রতিকার কি একবারও ভেবে দেখা হয়েছিল?
  • ৫. রিকশার বিকল্প হিসেবে তৈরি হয়েছে অটোরিকশা। এখন অটোরিকশা বন্ধ করে দিলে তার বিকল্প কী?

সরকার মূলত দুর্ঘটনা প্রতিরোধের চিন্তা থেকে অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ইস্যুতে উচ্চ আদালতেরও নির্দেশনা রয়েছে। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর প্রধান কারণ মোটর সাইকেল ও অটোরিকশা। এক অটোরিকশায় ৭ থেকে ৮ জন থাকে। একটা দুর্ঘটনা হলে অটোরিকশার সকলেই মারা যায়। আর মোটর সাইকেল তো আরেক উপদ্রব।’

সেতুমন্ত্রী এখানে ইজিবাইকের কথা বলেছেন। যেগুলো মহাসড়কে সত্যিই এখন বিরাট আতঙ্কের নাম। ধীর গতির এই বাহনের চালকের অধিকাংশই প্রশিক্ষিত নন। তাদের লাইসেন্স নেই। বিরাট অংশই একসময় রিকশা চালাতেন। অনেক কৃষি কাজ বা অন্য কোনও দিনমজুরি ছেড়ে টাকা পয়সা ধার দেনা করে ইজিবাইক কিনে রাস্তায় নেমেছেন। এগুলো গ্রাম উপশহর বা শহরের ভেতরের রাস্তায় চলাচল করার ফলে মানুষের যোগাযোগ সহজ হয়েছে, এটা যেমন ঠিক, তেমনি এগুলো আইন অমান্য করে মহাসড়কে উঠে যাওয়ায় দুর্ঘটনাও বাড়ছে।

কিন্তু ঢাকা শহরে আলোচনাটা হচ্ছে অটোরিকশা নিয়ে। আগে যেগুলো রিকশা ছিল এবং ব্যাটারি লাগিয়ে যেগুলোকে অটোরিকশা বানানো হয়েছে। এসব রিকশায় দুজনের বেশি ওঠা যায় না। অর্থাৎ পায়েচালিত রিকশাগুলোই এখন মেশিনে চলে। পার্থক্য এটুকুই। শহরের ভেতরে, ছোট রাস্তা ও গলির ভেতরে এসব অটোরিকশা ‍খুব বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে বলে শোনা যায় না।

তবে অনেকে অটোরিকশার চালক বেপরোয়া। অনেক সময়ই দেখা যায় তারা প্রাইভেটারের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে চান। এক্ষেত্রে ওই রিকশার আরোহীর সচেতনতাই যথেষ্ট। তিনি যদি রিকশাচালককে সাবধানে এবং ধীরে চালানোর অনুরোধ করেন কিংবা না শুনলে বাধ্য করতে পারেন, তাহলে এই প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা ধীরে ধীরে কমে আসবে। সুতরাং দুর্ঘটনা বেশি হয়—এই যুক্তিতে ঢাকা শহরে অটোরিকশা বন্ধ করে দেওয়ার সুযোগ নেই। যদি তাই হয় তাহলে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট পরিসংখ্যান থাকতে হবে যে, পায়েচালিত যেসব রিকশা অটোরিকশায় পরিণত হয়েছে, তাদের দুর্ঘটনার হার কেমন?

অটোরিকশার বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ বিদ্যুৎ অপচয়। বলা হয়, দেশে যখন বিদ্যুৎ সংকট এবং দেশের অনেক জায়গায় দীর্ঘ সময় লোডশেডিং, তখন এই অটোরিকশাগুলোর ব্যাটারি চার্জ দিতে গিয়ে প্রচুর বিদ্যুৎ চলে যায়। প্রশ্ন হলো, অটোরিকশায় যে পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগে, সেটি কি অপচয়? এটি তো ঘুরেফিরে অর্থনীতিতেই কাজে লাগছে। বিরাট সংখ্যক মানুষের জীবিকার সংস্থান হচ্ছে। মানুষের যাতায়াত দ্রুত ও সহজ হচ্ছে। সুতরাং অটোরিকশা বন্ধে এটিও কোনও যুক্তি হতে পারে না। বরং বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো এবং বিদ্যুতের চুরি ও অপচয় রোধ করা জরুরি।

আরেকটা সমস্যা হলো, ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করে দিলে পায়েচালিত রিকশার ভাড়া বেড়ে যাবে দ্বিগুণ। কারণ গত কয়েক বছরে অধিকাংশ রিকশাই ব্যাটারিচালিত হয়ে গেছে। ফলে এখন প্যাডেলচালিত রিকশার সংখ্যা খুবই কম। সেই কম সংখ্যক রিকশাচালক যাত্রীদের কাছে দ্বিগুণ তিন গুণ ভাড়া চাইবে। আবার দ্বিগুণ ভাড়া দিয়েও মানুষ তার সময়মতো রিকশা পাবে না। সুতরাং বিকল্প ঠিক না করে ব্যাটারি চালিত রিকশা বন্ধ করে দেয়া কোনো সমাধান নয়। বরং এতে জনভোগান্তি বাড়বে।

রাজধানীতে যেদিন অটোরিকশার চালকরা বিক্ষোভ করলো, সেদিন শর্মিলী জাহান নামে একজন অভিভাবক ফেসবুকে লিখেছেন: ‘অটোরিকশা কি আজ থেকে স্থায়ীভাবে বন্ধ হলো সবখানে? জানি না কিছুই। কোনো রিকশা না পেয়ে স্কুলে আসতে যেতে ছেলে নিয়ে ভোগান্তি হলো খুব তীব্র গরমে।’ অটোরিকশা বন্ধ করে দিলে এই ঘটনাগুলোই ঘটতে থাকবে।

আইনজীবী মাহবুবুল আলম লিখেছেন: ‘ব্যাটারি রিকশা থাকলে নতুন কোনো ব্যাটারি পরিবহন আনা সম্ভব হবে না।’

সুতরাং ঠিক কী কারণে সরকার অটোরিকশা বন্ধ করে দিতে চায়, সেটাও পরিষ্কার বোঝা দরকার।

দুর্ঘটনার দোহাই দিলে কোনও যানবহনই চলবে না। কেননা অটোরিকশা যদি মহাসড়ক এবং মূল সড়কে না ওঠে যদি ছোট রাস্তা এবং অলি-গলির ভেতরে চলাচল করে; যদি তারা বেপরোয়া গতিতে না চালায় তাতে দুর্ঘটনার কোনও শঙ্কা তৈরি হয় না। বরং একদিকে মানুষের যাতায়াত সহজ হবে, সময় বাঁচবে এবং অন্যদিকে অনেক লোকের কর্মসংস্থানও হবে।

যেকোনও সমস্যা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা উঠলে অনেকেই ইউরোপ-আমেরিকার ‍উদাহরণ দিয়ে বলেন, অমুক দেশে এটা নেই, তমুক দেশে এটা এরকম ইত্যাদি। এই মানসিকতার কারণে আমাদের রাজনীতিবিদরাও অনেক সময় বলে ফেলেন বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানানো হবে। এরকম উদ্ভট কথা বলার আগে তারা ভাবেন না সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা কত আর বাংলাদেশের কত? সিঙ্গাপুরের আয়তন কত আর বাংলাদেশের কত? যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের জিডিপির আকার ও মাথাপিছু আয় যে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড়, সেটাও তারা অনেক সময় খেয়াল করেন না। গরুর মাংসের দাম নিয়ে বিতর্ক উঠলে অনেকে আগপাছ চিন্তা না করেই বলে দেন নরওয়েতে গরুর মাংসের কেজি এত। অথচ নরওয়ের মানুষের মাসিক আয়, তার সামাজিক সুরক্ষা, তার জীবনমানের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান মেলানোর কোনও সুযোগ আছে কি না—সেটিও চিন্তা করেন না।

পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ একটি ইউনিক রাষ্ট্র। ছোট্ট আয়তনের একটা দেশে ১৭ কোটির বেশি মানুষ বসবাস করে। যে দেশের রাজধানীতেই বসবাস করে দুই আড়াই কোটি মানুষ। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের পুরো জনপদেই এত লোক থাকে না। সুতরাং সিঙ্গাপুর, নিউইয়র্ক, লন্ডন, অসলো শহরের ট্রাফিক সিস্টেমে ঢাকা শহর চলবে না। এখানের পরিকল্পনা হতে হবে ঢাকার মতো করেই।

বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে বাংলাদেশের মতো করে। সিঙ্গাপুর, নিউইয়র্ক, লন্ডনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এই শহরের ট্রান্সপোর্ট পরিকল্পনা প্রণয়নের সুযোগ নেই। ঢাকাকে অনেক দিন ধরেই ধনী লোকের শহরে পরিণত করার চেষ্ট আছে। যার অংশ হিসেবে ধারাবাহিকভাবে অনেক সড়কে রিকশা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রধান প্রধান সড়কে রিকশা একেবারেই নিষিদ্ধ। এর একটি প্রধান কারণ যানজট। কেননা দ্রুত গতির বাস ও প্রাইভেট কারের সঙ্গে একই লেনে রিকশা চললে সেটি শহরের গতি শ্লথ করে দেয়। কিন্তু ছোট রাস্তা এবং অলিগলির ভেতরে রিকশা বন্ধ করার কোনও সুযোগ নেই। মূল সড়কের বাইরে অন্য কোনও সড়ককে ভিআইপি ঘোষণা করে সেখানে রিকশা বন্ধ করার সুযোগ নেই। বরং এগুলোকে শৃঙ্খলায় আনতে হবে। বেপরোয়া চালানো বন্ধ করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে তাদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কোন এলাকায় কী পরিমাণ রিকশা দরকার তার একটা তালিকা করে এর চেয়ে বেশি পরিমাণ রিকশা যাতে রাস্তায় না নামে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সেজন্য অটোরিকশাগুলোকে লাইসেন্সের আওতায় আনতে হবে। মনিটরিং জোরদার করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশ এবং স্থানীয় রাজনৈতিক মাস্তানরা যাতে এগুলো থেকে অবৈধ সুবিধা নিতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি, বিকল্প ঠিক না করে কোনোভাবেই অটোরিকশা বন্ধ করে রাস্তায় জনদুর্ভোগ তৈরি করা যাবে না।

প্রসঙ্গত, অটোরিকশার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে অনেকে প্যাডেলচালিত রিকশাকে ‘অমানবিক’ বলে মন্তব্য করেছেন। কেননা একজন মানুষ অন্য দুজনক মানুষকে নিজের শারীরিক শক্তি দিয়ে টেনে নিয়ে যান। এটাকে অনেক সময় অনৈতিকও মনে হতে পারে। কিন্তু তার বিপরীতে এ কথাও সত্যি যে, রিকশা চালানোকে অমানবিক বললে আরও অনেক কাজকেই এই কাতারে ফেলতে হবে। যেমন কৃষিকাজেও প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। ট্রাফিক পুলিশরা রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে যেভাবে দায়িত্ব পালন করেন; যে নারী পাথর ভাঙেন; কল-কারখানায় যে শ্রমিকেরা কাজ করেন; যে শ্রমিকেরা ভারী মালামাল আনা-নেয়া করেন—সেসব কাজকেও অমানবিক মনে হতে পারে। যে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা শহর পরিষ্কার রাখেন, বিশেষ করে সুইপাররা যে ধরনের কাজ করেন, সেটাও কি মানবিক?

তার মানে এসব কাজ কি বন্ধ করে দেওয়া যাবে? যদি বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে পৃথিবীর পরিণতি কী হবে? সুতরাং প্যাডেলচালিত রিকশা অমানবিক বলে সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে—এই যুক্তিও খুব শক্তিশালী নয়। তাছাড়া যে ব্যক্তি এই কাজটি করছেন, তিনি যদি এটা করে সংসার চালাতে পারেন, আমাদের অসুবিধা কোথায়? যদি তিনি এটা করতে না চান তাহলে বিকল্প দেখবেন। আর যদি অধিকাংশ রিকশাচলকই এই বিষয়ে একমত হন যে, তারা রিকশায় প্যাডেল দেয়াটাকে অমানবিক ও অসম্মানজনক মনে করছেন, তখন রাষ্ট্র তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করবে অথবা চেষ্টা করবে। কিন্তু পরিশ্রমের ধরনের কারণে কোনো কাজকে অমানবিক বা অসম্মানজনক বলা যায় কি না, সেটা নিয়েও ভাবতে হবে।

আমীন আল রশীদ, সাংবাদিক, বাংলা ট্রিবিউন

cnews TODAY

The full form of cnewsTODAY is “Consumer News Today” is meant to be a supplement to the print edition, featuring consumer news, weekly briefs, sustainable campaign, videos, blogs, help to learn, photo galleries and additional content, opinions expressed are those of the writer and do not necessarily reflect the views of the consumers, members or volunteers of the organization “Society for Integrated Voluntary Affairs” registered under the law of “The Societies Registration Act, 1860 – in Bangladesh. It reflects the stories from every corner, NEWS from everywhere, network’s consumers, core mission of providing consumer news coverage and insights into the consumer safety, protection from business, and financial aspects of the world.

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button