Weekly Jonomot: A Rich History of Fifty-Two Years – Farooq Ahmad
সাপ্তাহিক জনমত: বায়ান্নো বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস: ফারুক আহমদ
ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত সবচে’দীর্ঘজীবী বাংলা পত্রিকা হচ্ছে সাপ্তাহিক জনমত। উপমহাদেশের বাইরে বাংলা পত্রিকা প্রকাশনার ইতিহাসে সাপ্তাহিক জনমত শুধু একটি মাইল ফলকই নয়; একইসঙ্গে বিলাতসহ ইউরোপের বাঙালি সম্প্রদায়ের প্রায় অর্ধ-শতাব্দীর একটি লিখিত ইতিহাসও বটে।
এ টি এম ওয়ালী আশরাফ, আনিস আহমদ, এস জেড শাহ ও রাব্বী মাহমুদ হাসানের মালিকানাধীনে এবং ফজলে রাব্বী মাহমুদ হাসানের সম্পাদনায় ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
তখন ‘জনমত পাবলিশার্স লি.’-এর পক্ষে আনিস আহমদ কর্তৃক দক্ষিণ লন্ডনের ৩০৩ ব্রিক্সটন রোড থেকে মুদ্রিত হয়ে ১৮ গ্যালভেস্টন রোড, পূর্ব পাটনি থেকে প্রকাশিত হয় (জনমত, ২৩ ডিসেম্বর ২০১০)। ম্যাগাজিন আকারের (১১.৭ মি. মি. ঢ ১৬.৫ মি. মি.) বিশ পৃষ্ঠার কাগজটির মূল্য ছিল এক শিলিং।
পত্রিকাটির প্রকাশনা সম্পর্কে প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলা হয়:
বিলাতে বসবাসকারী লক্ষাধিক বাঙালি। এদের মধ্যে একের সঙ্গে অন্যের এবং এদের সঙ্গে বহির্জগতের এবং দেশের সর্বপ্রকার পরিস্থিতির সঙ্গে এক কার্যকরি যোগসূত্র সৃষ্টি করাই এ পত্রিকার উদ্দেশ্য; দু’টি প্রশ্নই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া মাতৃভাষার মাধ্যমে একে অন্যের সংগে সংযোগ সৃষ্টি করা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পর্যায়ে মতামত ব্যক্ত করা এবং সর্বোপরি সংবাদ সরবরাহের সুবিধা বা সুযোগের প্রশ্নও সামান্য নয়।
এ পত্রিকা মূলতঃ সমাজকেন্দ্রিক, রাজনীতিকেন্দ্রিক নয়। তাই রাজনীতি পর্যালোচনাপেক্ষা গঠনমূলক সামাজিক চেতনা সৃষ্টি করার দায়িত্ব প্রাথমিক। বিলাতে বসবাসকারী বিপুলসংখ্যক বাঙালির প্রতিদিনের সমস্যা ও প্রশ্নের পরিচিতি দেয়া, সকলকে এ সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করে এবং সমস্যাগুলিকে মেনে নিয়ে সেগুলি সমাধানের পথে সাহায্য করা, এ পত্রিকার প্রাথমিক দিক। প্রবাসী বাঙালির দৈনন্দিন জীবন দেশীয় এবং বিদেশীয় রাজনীতি প্রত্যক্ষভাবে যতটা প্রভাবিত এবং যতটুকু প্রবৃত্ত করে, বিদেশে বসবাসকারী বাঙালির মুখপত্র হিসেবে জনমত-এর রাজনৈতিক দায়িত্ব ততটুকু।
জাতি হিসাবে বাঙালির স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট এবং এ দিক থেকে জনমত-এর আবেদন জাতীয়তাবাদ; দেশাত্ববোধের প্রশ্ন এখানে জড়িত।
২১শে ফেব্রুয়ারি জনমত প্রকাশনার দিন নির্ধারণের কারণ এতই স্পষ্ট যে, সে বিষয়ে কিছু বলা বাহুল্য না হলেও নিষ্প্রয়োজনীয়। পুনরাবৃত্তি হলেও এতটুকু বলা কর্তব্য যে, মাতৃভাষা দাবির প্রশ্নে যাঁরা শহীদ হয়েছেন এ দিনটিতে তাদের স্মরণ করলেই আমাদের দায়িত্ব সম্পূর্ণ হবে নাÑ এ সম্পর্কে গঠনমূলক কিছু করে সে সত্যকে সজীব রাখার প্রচেষ্টায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। বিলাতের এ ধরনের প্রচেষ্টা একেবারে প্রথম না হলেও এ আবেদন প্রথম এবং দৃষ্টিভঙ্গি মৌলিক এবং বিস্তীর্ণতর। তবু যে কথা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জনমত-এর জনপ্রিয়তা, স্বার্থকতা ও সমৃদ্ধি সব কিছুই আপনাদের সহযোগিতা, আনুকূল্য ও অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল। জনমত প্রসঙ্গে যে কোনো উপদেশ অথবা পরামর্শ আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করবো। যা কিছু ত্রুটি রইলো তা আপনাদের সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে সামান্য করে দেখবেন।
সাপ্তাহিক জনমতের আত্মপ্রকাশের সঙ্গে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয় রেনেসাঁসের যোগসূত্র বিদ্যমান। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ঘটে। ঠিক এরই সতের বছর পরে, ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনে একই দিনে জনমতের জন্মকে বিলাতের বাঙালি সম্প্রদায় বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের ফসল হিসেবে চিহ্নিত করেই গর্ববোধ করেন। জনমত তার জন্মের পর সূতিকাগার থেকে বেরুতে না বেরুতেই শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ। সে-সময় বিলাতের বাঙালি অধ্যুষিত প্রায় প্রতিটি উল্লেখযোগ্য শহর থেকে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রচারপত্র এবং সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে গৌরবজনক ভূমিকা পালন করলেও প্রচার ছিল এক-একটি এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন সাপ্তাহিক জনমত’ই ছিল বিলাতসহ সমগ্র ইউরোপে বাঙালি সম্প্রদায়ের নিরপেক্ষ ও নির্ভীক সংগ্রামী মুখপত্র। কাগজটি বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে এর পক্ষে জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে সাপ্তাহিক জনমতের ভূমিকা সম্পর্কে বহির্বিশ্বে নিযুক্ত মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি (পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লিখেছেন:
“ওয়ালী আশরাফ সম্পাদিত সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ অবদান রেখেছে। বাঙালি মহলে পত্রিকাটি ছিল বহুল প্রচারিত। ব্রিটেনের বাহিরেও প্রবাসীগণের অনেকে পত্রিকাটির গ্রাহক ছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তারা নিজেরাই পাকিস্তান দূতাবাস থেকে যে সব বিজ্ঞাপন নিয়মিত পেতেন সেগুলো প্রত্যাখান করেন। পত্রিকায় ওয়ালী আশরাফ ও আনিস আহমদ জোরালো ভাষায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে সম্পাদকীয় লিখেছেন (চৌধুরী ১৯৯২: ১৪৫)”।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বিলাতের বাঙালিদের নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে গঠিত স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য শেখ আব্দুল মান্নান লিখেছেন:
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের কালরাতে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশ আক্রমণ করে চারিদিকে বিভীষিকার জাল বিস্তার করে। তাদের উন্মত্ত দানবিকতা সমস্ত বাংলাদেশকে কসাইখানায় পরিণত করে। দেশবাসীর এই মর্মভেদী দুর্যোগের সময় বিলাতে বাঙালির ‘সবেধন নীল মণি’ জনমত বাঙালির পাশে এসে দাঁড়ায়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধে জনমত-এর অংশগ্রহণ। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান সরকার জনমত’কে বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করে দেয়। শুধু তা’ই না, আবুল হায়াত নামে এক বাঙালিকে সম্পাদক করে পাকিস্তান হাইকমিশন প্রকাশ করে মুক্তি নামে এক বাংলা সাপ্তাহিক। ইতিহাস সৃষ্টিকারী এ যুগসন্ধিক্ষণে সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও জনমত স্বাধীনতাযুদ্ধে এক গৌরবময় ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হয়েছে […] (জনমত, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮)।
বাঙালি জাতির নির্ভীক নিরপেক্ষ সংগ্রামী মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক জনমতের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রবাসে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের বাহনরূপে প্রবাসীদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার প্রকাশসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের মিশন হিসেবে। এ মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রথমে জনমত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ফজলে রাব্বী মাহমুদ হাসান। তখন তিনি ও প্রকাশক আনিস আহমদ ছাড়া অন্য কারো নাম পত্রিকায় প্রকাশ করা হত না। তবে ফজলে রাবীŸ মাহমুদ হাসানের কর্মকাল খুব বেশি দিন স্থায়ী ছিল না। পত্রিকার নীতিসংক্রান্ত বিষয়ে অন্যান্য পরিচালকদের সঙ্গে তার মতভেদ দেখা দেয়ায় তিনি সম্পাদনা ও পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরে দাঁড়ালে (১ম বর্র্ষ ৪০তম সংখ্যার পর) ১৯৬৯ সালের ২১ নভেম্বর থেকে প্রধান সম্পাদক হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন টি এম ওয়ালী আশরাফ এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে আনিস আহমদ। তার পর থেকে উভয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ১৯৮৯ সালের ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একসঙ্গে জনমতকে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যান।
তখন জনমতের সংবাদের উৎস ছিল:
ক. বিবিসি ও এখানকার ইংরেজি সংবাদপত্রগুলোর খবরা-খবর,
খ. দেশ থেকে আসা দৈনিক পত্রপত্রিকা থেকে সংবাদ বাছাই ও সংকলন,
গ. বিলাতের বাঙালি-সম্প্রদায়ের খবরাখবর, প্রেস বিজ্ঞপ্তি, ইশতিহার ও চিঠিপত্র ইত্যাদি।
এ ধারাকে আরেকটু গতিশীল করতে ১৯৭০ সালের ২৫ ডিসেম্বর (দ্বিতীয় বর্র্ষ ৪৫তম সংখ্যা) থেকে দেশের পাশাপাশি ইংল্যান্ড ও ইউরোপের কয়েকটি দেশেও কয়েকজন প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়। তখন ঢাকা প্রতিনিধি ছিলেন: রকিব আহমদ, পশ্চিম জার্মানি: এম এম আব্দুল্লা, পশ্চিম পাকিস্তান: হাসান শাহরিয়ার, ব্রাডফোর্ড: এল রহমান, কভেন্ট্রি: তোফাজ্জল হোসেন এবং বার্মিংহাম প্রতিনিধি: মো. আব্দুল জব্বার খান।
কিন্তু এতে পত্রিকাটির সংবাদ পরিবেশনে যে খুব একটা গতিশীলতা বা বৈচিত্র্য এসেছিল তা নয়। এজন্য মূলত দায়ী ছিল তখনকার পত্রিকা প্রকাশনার বৈরী পরিবেশ। কারণ, তখনো বাংলা টাইপরাইটার, টেলিফোন, ফ্যাক্স, ই-মেইল, কম্পিউটার, বাংলাদেশি সংবাদ-সংস্থা ইত্যাদি এখনকার মতো সহজলভ্য ছিল না। তখন পত্রিকায় যারা কাজ করতেন, তারা স্বদেশ, স্ব-ভাষা ও স্বজাতির প্রতি অসীম মমত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়েই অনেকটা বিনা পারিশ্রমিকে, ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো’ কাজ করতেন। তখন এদেশে বাঙালি জনসংখ্যা যেমন ছিল সামান্য ঠিক তেমনি পাঠক সংখ্যাও ছিল হাতেগোণা। ছিল না বিজ্ঞাপন দেয়ার মতো বাঙালিদের পর্যাপ্ত ব্যবসা-বাণিজ্য। এর পরেও মাত্র এক শিলিং মূল্যে পত্রিকা বিক্রি করে, তা থেকে কমিশন বাদ দিয়ে পাওয়া সামান্য আয় এবং বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভর করে বিলাতের মতো একটি যান্ত্রিক-সভ্যতার দেশ থেকে বাংলা পত্রিকা চালানো ছিল সত্যি একটি অসাধারণ ঘটনা। অথচ তখন জনমত একটু নমনীয় ভূমিকা পালন করলে এর আর্থিক দিক হয়তো অনেকটা স্বচ্ছল হতে পারত। কিন্তু এমনটি হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এ কাগজটি যেমন সমগ্র ইউরোপে এককভাবে বাঙালি সম্প্রদায়ের মুখপত্র হিসেবে আপোষহীন ভূমিকা পালন করেছে; ঠিক তেমনি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের গণতন্ত্রের জন্য, সামরিক স্বৈরশাসন ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ইত্যাদির বিরুদ্ধে আপোষহীন ভূমিকা পালন করে। ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যেমন পাকিস্তান দূতাবাস জনমতকে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়, ঠিক তেমনি স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সও অনেকবার বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করে দেয়। এখানেই শেষ নয়, বরং ১৯৭৫ সালের ৪ জুলাই থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সেও সাপ্তাহিক জনমত সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয় (জনমত, ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫)। কিন্তু কোনোভাবেই জনমতের আপোষহীন ভূমিকাকে দমিয়ে রাখা যায়নি।
সাপ্তাহিক জনমতের জন্ম হয়েছিল ১৯৬৯ সালের বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের গর্জনমুখর দিনে বিলাত-প্রবাসী বাঙালিদের সংগ্রামী মুখপত্র হিসেবে। সে সময় থেকে সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের স্বাধীনতা-সংগ্রাম, বাহাত্তর ও তিয়াত্তরের দেশ পুনর্গঠন, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, পঁচাত্তরের একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ প্রবর্তন এই ধারাবাহিকতায় প্রবাসী বাঙালিদের মূল দৃষ্টি ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের পর থেকে প্রবাসীরা স্বপ্নভঙ্গের হতাশা নিয়ে কিছুটা হলেও অন্যত্র দৃষ্টি ফেরান।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে একের পর এক রাজনৈতিক অস্থিতিশীল ঘটনাপ্রবাহ অর্থাৎ দিন-দুপুরে ছিনতাই, রাতে ডাকাতি ইত্যাদি নানা হয়রানির শিকার হন প্রবাসীরা। এগুলোর সমাধান হতে না হতেই চলে আসে প্রাকৃতিক-দুর্যোগ। প্রবাসীরা তখন দেশের এহেন পরিস্থিতিতে ব্যাপকহারে পোষ্যদের বিলাত নিয়ে আসতে শুরু করেন। ফলে এদেশের বাংলা পত্রপত্রিকার পাঠক যেমন তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে, ঠিক তেমনি এদের চাহিদা ও দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন ঘটে। এমনই অবস্থায় প্রবাসী বাঙালি সম্প্রদায়ের চাহিদাকে সামনে রেখে জনমত-এর মনোপলি বাজারে লন্ডন থেকে জাগরণ নামে আরেকটি বাংলা পত্রিকার আবির্ভাব হয়। তখন জনমত এর বয়স সাত বছর। একটি পত্রিকার জন্য সাতটি বছর নিতান্ত কম সময় নয়। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে কাগজটির মাত্র দু’টি পরিবর্তন ছাড়া আর তেমন কোনো উল্লে¬খযোগ্য পরিবর্তন হয় নি। সেগুলো ছিল, দ্বিতীয় বর্র্ষ ৪৫ তম সংখ্যা (২৫ ডিসেম্বর ১৯৭০) থেকে বিভিন্ন স্থানে সংবাদদাতা নিয়োগ এবং চতুর্থ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা থেকে এ-থ্রি সাইজের বিশ পৃষ্ঠার ম্যাগাজিন আকারের কাগজটি ষোল পৃষ্ঠার ট্যাবলয়েড সাইজের সাপ্তাহিকে রূপান্তরিত হয়। এছাড়া পত্রিকাটির প্রত্যেক পৃষ্ঠায় ছিল পুরোনো গন্ধ। জনমতে প্রকাশিত তখনকার সংবাদগুলো পড়লে প্রায়ই বিভ্রম সৃষ্টি হয় যে, পত্রিকাটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত নাকি বিলাত থেকে।
সাপ্তাহিক জনমতের এ ধরনের অবস্থার মধ্যে, ৫ম বর্র্ষ ৭ম সংখ্যায় একটি উল্লেখযোগ্য সংবাদ ছিল, ‘ঢাকায় সাপ্তাহিক জনমত: ওয়ালী আশরাফ সম্পাদক নিযুক্ত। এতে বলা হয়:
ঢাকা–২৬ মার্চ: আজ এখানে সাপ্তাহিক জনমত নামে আরো একটি নতুন বাংলা পত্রিকা আতœপ্রকাশ করেছে। এই নতুন পত্রিকাটির প্রধান সম্পদক নিযুক্ত হয়েছেন লন্ডনস্থ বাংলা সাপ্তাহিক জনমত-এর প্রধান সম্পাদক ওয়ালী আশরাফ এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হয়েছেন আবু আব্দুল্লাহ (নাছের মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ এবং কার্যকারী-সম্পাদক: দেওয়ান শামসুল আরেফিন লেখক)। (জনমত, ১ এপ্রিল ১৯৭৩; হক, ১৯৮৪: ২১২)।
এ ধরনের সংবাদ সংকলনের সময়েই ১৯৭৬ সালের মধ্যভাগে জনমত-এর নির্বাহী-সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন সাংবাদিক কাদের মাহমুদ। তার যোগদানের পর থেকেই ধীরে ধীরে কাগজটির সনাতনী সংবাদ পরিবেশনের সেকেলে ধারায় প্রথম আঘাত আসে এবং সে অভিঘাতের মধ্য দিয়েই পত্রিকাটির গায়ে সার্বিক উন্নয়নের শিহরণ জাগে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও তিনি পত্রিকাটির উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, বাংলাদেশের খবর সঙ্কলনের পরিবর্তে সেগুলোকে সম্পাদনার মাধ্যমে বিলাতের পাঠকদের উপযোগী করে প্রকাশনা। বাংলাদেশের সর্বশেষ খবরের জন্য সপ্তাহে অন্তত একবার ঢাকার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ; এদেশে বসবাসকারী সিংহভাগ বাঙালি জনগোষ্ঠী বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষ। সেজন্য সিলেট অঞ্চলের খবরাখবরকে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশের জন্য সিলেটে জনমত-এর একজন প্রতিনিধি নিয়োগ; বিলাতের বাঙালি সংগঠনগুলোর ইশতিহারগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে প্রকাশ করা; স্থানীয় সংবাদদাতাদের কাছ থেকে চলতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর খবরাখবর নেয়া; ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে বাঙালিদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা এবং এদেশে বাঙালিদের সেবার ব্যাপারে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর উপরে নজর রাখা ইত্যাদি। এছাড়া বলা যায়, তিনি জনমত এর সাহিত্য পাতাকেও এমনভাবে ঢেলে সাজিয়ে ছিলেন যে, বিলাতের লেখক-লেখিকারা তাদের গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ ইত্যাদি দিয়ে কাগজটিকে অনেকটা সমৃদ্ধ করেছিলেন। ঠিক এ সময়ে কাগজটিতে যোগদান করেন শিল্পী মাহবুবুর রশীদ। পত্রিকাটির তখনকার সংখ্যাগুলো হাতে নিলেই বুঝা যায়, এটির অঙ্গসজ্জা ও শিরোনাম ইত্যাদিতে তার মাধ্যমে অনেক মৌলিক পরিবর্তন এসেছিল (জনমত, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮)। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, মুদ্রণশিল্পের বৈপ্লবিক যুগের সে সময়ে বিশ্বের একটি শ্রেষ্ঠ নগরী লন্ডন শহরে জনমত টাইপসেটিংয়ের মাধ্যমে আরো উন্নতভাবে প্রকাশ করা খুব একটা ব্যয়বহুল না হলেও পত্রিকাটি তখনও প্রকাশিত হত টাইপরাইটারের মাধ্যমে।
এখানে উল্লেখ্য যে, সাংবাদিক কাদের মাহমুদ জনমত এ যোগদানের পর এ টি এম ওয়ালী আশরাফ, আনিস আহমদ ও এস জেড শাহ’র মালিকানাধীনে সাপ্তাহিক জনমত-এর এক রজতকাল এসেছিল বলা যায়। কারণ, তখন কাগজটির সার্বিক উন্নতি হচ্ছিল। এছাড়া ছিল কেন্ লিভিংস্টোনের জিএলসি’র আমল (১৯৭৩-১৯৮৬)। জিএলসি থেকে রাজধানীর সংখ্যালগু সম্প্রদায়ের পত্রিকাগুলোতে নিয়মিতভাবে বিজ্ঞাপন দেয়া হত। সাপ্তাহিক জনমত ও সে বিজ্ঞাপনগুলো পেয়েছিল। অথচ সেই বিজ্ঞাপনের অর্থ দিয়ে কাগজটির সাংগঠনিক যে উন্নতি হওয়ার কথা ছিল অথবা বলা যায় হওয়া উচিৎ ছিল, রহস্যজনকভাবে তা হয় নি বরং পরিচালকরা আর্থিক করণে পত্রিকাটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।
এ বিষয়ে নির্বাহী সম্পাদক কাদের মাহমুদ বলেন, ‘আমার সামান্য জ্ঞানে মনে হয়, যে মালিকানা সংগঠনের প্রয়োজনে পেশাদার ব্যবস্থাপনা নিয়োগ ও ব্যবহার করতে পারে না, সে মালিকানা টিকে থাকতে পারে না; জনমত-এর বেলায়ও সম্ভবত সে সময় এটা ঘটেছিল (জনমত, ২০ ফেব্রয়ারি ১৯৯৮)।
তবে একথা সত্য যে, ওয়ালী আশরাফ, আনিস আহমদ ও এস জেড শাহ’র মালিকানাধীনে এবং এ টি এম ওয়ালী আশরাফ ও আনিস আহমদের সম্পাদনাকালেই আর্থিক বিষয় ছাড়া জনমত সকল দিক দিয়েই উন্নতিলাভ করে। অর্থাৎ একটি জনপ্রিয়, সর্বাধিক বিক্রিত ও নিয়মিতভাবে প্রকাশিত প্রথম শ্রেণির কাগজে উন্নীত হয়। ওয়ালী আশরাফ এবং আনিস আহমদের যৌথ সম্পাদনাকালীন সময়সীমা ছিল উনিশ বছর দশ মাস পনের দিন। এ সময়ে কাগজটি স্থান পরিবর্তন করে তিন বার এবং মূল্য বৃদ্ধি পায় ছয় বার।
ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, এটি ‘জনমত পাবলিশার্স লি.’-এর পক্ষে আনিস আহমদ কর্তৃক, দক্ষিণ লন্ডনের ৩০৩ ব্রিক্সটন রোড থেকে মুদ্রিত হয়ে ১৮ গ্যালভেস্টন রোড, পূর্ব পাটনি থেকে প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যা থেকে কাগজটির মূল্য ছিল পাঁচ শিলিং, ২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ (৩য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা) মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে হয় আট পেন্স; ৩য় বর্ষ, ৩৭তম সংখ্যার পর দশ পেন্স; ৭ম বর্র্ষ ১ম সংখ্যা থেকে (১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৫) পনের পেন্স; ৯ম, বর্ষ ৩০তম সংখ্যা থেকে বিশ পেন্স এবং ১৩শ বর্র্ষ ২৩তম সংখ্যা (১১ জুলাই, ১৯৮১) থেকে ত্রিশ পেন্স।
আগেই বলেছি যে, আর্থিক কারণে এ টি এম ওয়ালী আশরাফ ও এস জেড শাহ জনমত বিক্রি করে দেন। জানা যায়, পূর্ব থেকেই এ টি এম ওয়ালী আশরাফের পরিকল্পনা ছিল সপরিবারে বাংলাদেশে গিয়ে রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন। জনমত বিক্রি করে দেয়ার এটাও একটি অন্যতম কারণ। তখন থেকে কাগজটির অন্যতম কর্ণধার আনিস আহমদ জনমতের ভারপ্রাপ্ত প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯০ সালের ৬ এপ্রিল থেকে নতুন মালিকানাধীনে সম্পাদনা বিভাগে পরিবর্তন আসে। তখন প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন আনিস আহমদ; ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। ৩০ আগস্ট থেকে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপান সৈয়দ সামাদুল হক এবং ব্যবস্থাপনা সম্পাদক থেকে উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয় শামসুদ্দিন চৌধুরীকে মানিক। কিন্তু ১৯ অক্টোবর আবারও সম্পাদনা পরিষদ হতে শামসুদ্দিন চৌধুরীর নাম বাদ পড়ে।
মালিকানা ও সম্পাদনা বিভাগে পরিবর্তনের সেই সময়ে অর্থাৎ ২৪ অক্টোবার ১৯৯০ (২২ বর্ষ, ২৩ তম সংখ্যা) থেকে জনমত আবার স্থান পরিবর্তন করে ইউনিলিঙ্ক প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যানারে, সেলক্রিক রোড, লন্ডন এসডব্লিউ১৭ থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। তখন পরিচালনা বোর্ডের নতুন সদস্য হিসেবে যোগদান করেন নবাব উদ্দিন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ থেকে জনমতের কর্ম্যাধ্যক্ষ হিসেবে সম্পাদনা বিভাগে নবাব উদ্দিনের নাম প্রকাশিত হয়। সেলক্রিক রোডে পত্রিকাটির স্থায়িত্ব ছিল মাত্র আট মাস দশ দিন।
১৯৯১ সালের ১৭ জুলাই কাগজটি প্রথমবারের মতো সাউথ লন্ডন থেকে বিলাতের বাংলা পত্রিকার ফ্লিট স্ট্রিট হিসেবে খ্যাত পূর্ব লন্ডনের, ইউনিট-২, ২০বি স্পেলম্যান স্ট্রিট, লন্ডন ই১ এ ঠিকানায় স্থানান্তরিত হয়। শুরু হয় বাঙালির প্রাণকেন্দ্র থেকে সাপ্তাহিক জনমতের নতুন যাত্রা। ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে পত্রিকাটির পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন নুরুল ইসলাম হোসেইন। ১৯৯৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে সম্পাদনা বিভাগে ডেপুটি-এডিটর হিসেবে কামাল কোরেশি, সিনিওর সংবাদদাতা হিসেবে এস এম আলম চৌধুরী এবং পাবলিক রিলেশন ও ফটোগ্রাফি কর্মকর্তা হিসেবে দানেস আহমদ জেপি’র নাম প্রকাশিত হয়। এ সময় সাপ্তাহিক জনমতে’র পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিলাতের বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ডাক্তার মাসুদ আহমেদকে স্বর্ণপদক প্রদান করে একটি অনুকরণীয় দৃষ্ঠান্ত স্থাপন করে।
১৯৯৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পাবলিক রিলেশন ও ফটোগ্রাফি থেকে দানেস আহমদ জেপি ম্যানেজিং এডিটর পদে উন্নীত হন। এই পর্যায়ে জনমত পরিবারে স্টাফ রিপোর্টার পদে মুসলেহ উদ্দিন আহমদ ও সার্কুলেশনে আব্দুল আজিজ যোগদান করেন। ১৯৯৭ সালের ১৬ জানুয়ারি, প্রধান সম্পাদক আনিস আহমদ, সাপ্তাহিক জনমতে তার প্রায় তিন দশকের মালিকানা ও সম্পাদনার ইতি টেনে স্থায়িভাবে বসবাসের জন্য বিলাত ছেড়ে বাংলাদেশে চলে যান। ফলে কাগজটির সম্পাদনা বিভাগে আবারও পরিবর্তন আসে। এ সময় পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন নুরুল ইসলাম হোসেইন, সম্পাদক: সৈয়দ সামাদুল হক, অ্যাক্টিং এডিটর: নবাব উদ্দিন, ডেপুটি এডিটর: কামাল কোরেশি, নিউজ এডিটর: সুজাত মনসুর, স্টাফ রিপোর্টার: মুসলেহউদ্দিন আহমদ ও সার্কুলেশনে এ আজিজ দায়িত্ব লাভ করেন।
এই পরিবর্তনের মাত্র এক বছরের মাথায় সৈয়দ সামাদুল হক ‘বাংলাদেশ নিউজ সার্ভিস’ (বিএনএস) নামক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য ১৯৯৭ সালের ৩০ অক্টোবর (২৯ শ বর্ষ, ৪২তম সংখ্যা) জনমতের সম্পাদনা ও মালিকানা ছেড়ে চলে যান। পরে তার সহযাত্রী হন কামাল কোরেশীও। এই পর্যায়ে পরিচালনা পর্ষদের নতুন সদস্য হন আমিরুল চৌধুরী।
১৯৯১ সালের ১৭ জুলাই কাগজটি প্রথমবারের মতো সাউথ লন্ডন থেকে বিলাতের বাংলা পত্রিকার ফ্লিট স্ট্রিট হিসেবে খ্যাত পূর্ব লন্ডনের, ইউনিট-২, ২০বি স্পেলম্যান স্ট্রিট, লন্ডন ই১ এ ঠিকানায় স্থানান্তরিত হয়। শুরু হয় বাঙালির প্রাণকেন্দ্র থেকে সাপ্তাহিক জনমতের নতুন যাত্রা। ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে পত্রিকাটির পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন নুরুল ইসলাম হোসেইন। ১৯৯৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে সম্পাদনা বিভাগে ডেপুটি-এডিটর হিসেবে কামাল কোরেশি, সিনিওর সংবাদদাতা হিসেবে এস এম আলম চৌধুরী এবং পাবলিক রিলেশন ও ফটোগ্রাফি কর্মকর্তা হিসেবে দানেস আহমদ জেপি’র নাম প্রকাশিত হয়। এ সময় সাপ্তাহিক জনমতে’র পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিলাতের বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ডাক্তার মাসুদ আহমেদকে স্বর্ণপদক প্রদান করে একটি অনুকরণীয় দৃষ্ঠান্ত স্থাপন করে।
১৯৯৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পাবলিক রিলেশন ও ফটোগ্রাফি থেকে দানেস আহমদ জেপি ম্যানেজিং এডিটর পদে উন্নীত হন। এই পর্যায়ে জনমত পরিবারে স্টাফ রিপোর্টার পদে মুসলেহ উদ্দিন আহমদ ও সার্কুলেশনে আব্দুল আজিজ যোগদান করেন। ১৯৯৭ সালের ১৬ জানুয়ারি, প্রধান সম্পাদক আনিস আহমদ, সাপ্তাহিক জনমতে তার প্রায় তিন দশকের মালিকানা ও সম্পাদনার ইতি টেনে স্থায়িভাবে বসবাসের জন্য বিলাত ছেড়ে বাংলাদেশে চলে যান। ফলে কাগজটির সম্পাদনা বিভাগে আবারও পরিবর্তন আসে। এ সময় পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন নুরুল ইসলাম হোসেইন, সম্পাদক: সৈয়দ সামাদুল হক, অ্যাক্টিং এডিটর: নবাব উদ্দিন, ডেপুটি এডিটর: কামাল কোরেশি, নিউজ এডিটর: সুজাত মনসুর, স্টাফ রিপোর্টার: মুসলেহউদ্দিন আহমদ ও সার্কুলেশনে এ আজিজ দায়িত্ব লাভ করেন।
এই পরিবর্তনের মাত্র এক বছরের মাথায় সৈয়দ সামাদুল হক ‘বাংলাদেশ নিউজ সার্ভিস’ (বিএনএস) নামক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য ১৯৯৭ সালের ৩০ অক্টোবর (২৯ শ বর্ষ, ৪২তম সংখ্যা) জনমতের সম্পাদনা ও মালিকানা ছেড়ে চলে যান। পরে তার সহযাত্রী হন কামাল কোরেশীও। এই পর্যায়ে পরিচালনা পর্ষদের নতুন সদস্য হন আমিরুল চৌধুরী।
২০০০ সালে জনমতের নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দেন ইসহাক কাজল। তখন জনমত পরিবারের ছিলেন Ñ ইমামুল ইসলাম চৌধুরী (পরিচালক), আমিরুল ইসলাম চৌধুরী (ম্যানেজিং ডাইরেক্টর), মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ (পরিচালক ও বার্তা সম্পাদক), ইসহাক কাজল (রাজনৈতিক সম্পাদক), জুবায়ের আলী (অফিস ম্যানেজার) ও মো. কে এইচ ফখরুল কামালী (সার্কুলেশন) প্রমুখ। এর পরে আরও অনেকের আনাগোনা হয়েছে। ২০০২ সালের ১ মে সাপ্তাহিক পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিয়ে জনমতের অন্যতম পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক পদে যোগ দেন সৈয়দ নাহাস পাশা। তারপর কাগজটির পরিচলনা পর্ষদে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে ২০১৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। তখন পরিচালক হিসেবে যোগ দেন আরও তিনজন। এরা হলেনÑ আতিক চৌধুরী, জুনায়েদ চৌধুরী ও জসিম আহমদ।
তখন আবারও নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হয় জনমত পরিবারকে। সম্পাদনা পর্ষদ ছিলো এরকমÑ চিফ এডিটর সৈয়দ নাহাস পাশা; এডিটর নবাব উদ্দিন; ম্যানেজিং ডাইরেক্টর আমিরুল চৌধুরী; এক্সিকিউটিভ এডিটর সাঈম চৌধুরী; নিউজ এডিটর মোসলেহউদ্দিন আহমদ; পলিটিক্যাল এডিটর ইসহাক কাজল; কমিউনিটি নিউজ এডিটর মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া; স্টাফ রিপোর্টার নজমুল ইসলাম, মো. হাবিবুর রহমান ও নূজহাত নূর সাদিয়া; স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার ও আবু মুসা হাসান; স্পেশাল কন্ট্রিবিউটর মো. সাজিদুর রহমান; টাওয়ার হ্যামলেট্স করেসপন্ডেন্ট আহাদ চৌধুরী বাবু; গ্রাফিক ডিজাইন ও প্রোডাকশন বিভাগে অপু রায় ও সালেহ আহমদ; মার্কেটিং ও এডভার্টাইজিংয়ে গোলাম মোহাম্মদ কিনু এবং সার্কুলেশন বিভাগে হাবিবুর রহমান হাবিব ও আব্দুল মুহিত রাশু।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সম্পাদনা ও পরিচালনা – উভয় ক্ষেত্রেই বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। সম্পাদক পদ থেকে অবসর নেন নবাব উদ্দিন। প্রায় একই সময়ে নির্বাহী সম্পাদক পদ থেকে সায়েম চৌধুরী, কমিউনিটি নিউজ এডিটর ইমরান আহমদ ও গ্রাফিক ডিজাইনার অপু রায়ও অব্যহতি নেন। সেই থেকে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সৈয়দ নাহাস পাশা। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালনকারী আমিরুল ইসলাম চৌধূরী। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে এর হাল ধরেছেন তরুণ ব্যবসায়ি জুনেদ চৌধুরী। চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছে বিশিষ্ট শিল্পপতি, রেস্টুরেটার্স ও কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব আতিক চৌধুরী। জনমত ডটকম নামে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল পেপারও এখন ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। প্রিন্ট এবং অনলাইন জনমত এর সর্বাংশ জুড়ে রয়েছেন সাংবাদিক মাহবুব রহমান।
২০১৮ সালে প্রকাশনার অর্ধ শত বছর পালনের উদ্যোগ নিলেও অভ্যন্তরীন জটিলতা এবং পরবর্তীতে কোভি-১৯ মহামারীজনিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের সকল আয়োজনকে পিছিয়ে দেয়। আজ জনমত ৫৩ বছরে পা দিলো। অর্ধ শত বছর পূর্তি উৎসবের ট্যাগলাইন ‘শতাব্দী ছোঁয়ার দূর্নিবার আকাঙ্খা’ অনুযায়ি জনমত শত বর্ষ বেঁচে থাকবে – এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক পরিচিতিঃ ফারুক আহমদ লেখক, সাংবাদিক এবং গবেষক। বিলাতে বাংলা সংবাদপত্র, সাংবাদিকতার ইতিহাস, কমিউনিটি ও রাজনৈতিক সংগঠন ও কাজের ইতিহাস, সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস নিয়ে অনেকগুলো গবেষণা গ্রন্থ লিখেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে সাপ্তাহিক জনমত এর ভূমিকা নিয়ে তিনি ২৭৫ পৃষ্ঠার গবেষণা গ্রন্থ “সাপ্তাহিক জনমত – মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল” লিখেছেন, যা ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়।